শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

# মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় উর্দু ফার্সি: অপাংক্তেয় না অপরিহার্য?

মুফতি মুহাম্মাদ মামুনুল হক..
কওমী মাদরাসায় পড়া-লেখার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একজন শিক্ষার্থীর যে পরিমাণ ভাষাজ্ঞান অর্জন করা চাই, সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে বর্তমানে মাদরাসাশিক্ষার বিরাজমান অবস্থার সামান্য বিশ্লেষণ হয়ে যাওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে ৷
ঐতিহ্যগতভাবে কওমী মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলামে আমরা ভাষাশিক্ষার যা কিছু পেয়েছি তা প্রতিটি ভাষার ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণে উল্লেখ করতে চাই -
আরবী:
আমরা আমাদের মেধা ও যোগ্যতার বিপর্যয়ের যুগেও কওমী মাদরাসা শিক্ষাকারিকুলামের বৈশিষ্ট যতটুকু পেয়েছি তাতে শিক্ষাজীবন শেষে আরবীভাষার উপর এতটুকু যোগ্যতা একজন শিক্ষার্থীর হতে হবে যাতে সে তিনটি কিতাব অন্তত সরাসরি আরবী থেকে কোনো অনুবাদের সহায়তা ছাড়াই বুঝতে সক্ষম হয় ৷ কিতাব তিনটি হল-
পবিত্র কুরআন শরীফ
মেশকাত শরিফ ও
কিতাবুল হেদায়াহ
এই তিনটি কিতাব বুঝতে যেই পরিমাণ নাহু,সরফ ও শব্দার্থ জানা দরকার ততটুকু প্রত্যেককেই শিখতে হবে ৷ এতটুকু আরবীভাষার যোগ্যতাকে কওমী মাদরাসা শিক্ষার সর্বনিম্ন লক্ষমাত্রা বলা যেতে পারে ৷ আর এর উপরে পর্যায়ক্রমিক নিম্নোক্ত স্তরগুলো অতিক্রম করা উচ্চ লক্ষমাত্রা হিসাবে অভিহিত হতে পারে ৷ যেমন-

ক, আরবীতে লিখিত তাফসীর, হাদীস ও ফিকহের বড় বড় কিতাবগুলো অনায়াসে বুঝতে পারা ৷
খ, আরবী বালাগাতের আলোকে কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য অনুধাবন করতে পারা ৷
গ, বর্তমান আধুনিক কালে রচিত উলূমে ইসলামিয়ার রচনাবলী বুঝতে পারা ৷
ঘ, আরবীতে রচনা লিখতে পারা এবং
ঙ, আরবীতে কথোপকথন করতে পারা ৷
উপরোক্ত বর্ণনাক্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি করা আজকের চিন্তাশীলদের জন্য নেহায়েত জরূরী ৷
বাংলা:
মাতৃভাষা হওয়ায় আমাদের জন্য বাংলায় কথা বোঝা, কথা বলা ও সাধারণ বাংলা পড়তে পারা সহজ ৷ বিশেষ পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই ৷ তাই শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়ের দিকে আলাদা কোনো নযর নেই ৷ তবে বাংলায় লিখতে পারার উপর বিশেষ গুরুত্বের উপলব্ধি থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই ৷ থাকলেও অপ্রতুল ৷ বাংলা সাহিত্য চর্চার একাডেমিক কোনো ব্যবস্থা বলতে গেলে নেই ৷
আগে যখন কুরআন-হাদীস ও আরবী অন্যান্য কিতাবের তরজমা উর্দূতে পড়ানো হতো তখন অনেক ছাত্র বাংলায় সাবলীলভাবে অনুবাদ করতে পারতো না ৷ এখন অবশ্য এ বিষয়ে যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে বলা যায় ৷
উর্দূ:
কোনো কোনো মাদরাসায় আমাদের সময় উর্দূখানা নামে একটা বিশেষ ক্লাস থাকলেও অনেক মাদরাসায়ই তা ছিল না ৷ প্রথম থেকে চতুর্থ জামাত/হেদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত কিছুকিছু উর্দূ কিতাব ছিল ৷ আর বিশেষভাবে উর্দূর প্রচলনটা ছিল মূলত আরবী-ফার্সি কিতাব সমূহের তরজমার ক্ষেত্রে ৷ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সবকের ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ বাংলায় হলেও তরজমাটা উর্দূতেই করা হতো ৷ আর উর্দূ ব্যখ্যাগ্রন্থাদি অধ্যয়নের ব্যপক পরিবেশ ছিল ৷ এতে উর্দূর এমন যোগ্যতা অর্জন হতো যে উর্দূ লেখা ও বলা নিখুঁত না হলেও উর্দূ পড়ে ও শুনে বুঝতে কোনো সমস্যা হতো না ৷ কিন্তু এ অবস্থার ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে ৷ এখন প্রায় সকল ক্ষেত্রে এমন অবস্থা যে, উর্দূতে কিছু বলবে তো দূরের কথা একটু কঠিন কিতাবাদি পড়ে বুঝবে তাও সুদূরপরাহত ৷ হযরত থানভী রহঃএর বয়ানুল কুরআন বা খুতুবাত বুঝতে সক্ষম নয় বর্তমানের অধিকাংশ তালিবে ইলম ৷ এমনকি মেধাবিরাও ৷ উর্দূ শুনে বুঝার মানুষও দিনদিন কমে আসছে ৷
ফার্সি:
কওমী মাদরাসার পূর্ণ সিলেবাসে ফার্সিভাষার ব্যকরণিক একটি মাত্র কিতাব তাইসীরুল মুবতাদী আছে ৷ তাও আবার পড়ানো হয় বছরে ছয়মাস ৷ একই তাইসীরুল মুবতাদী আবার শব্দার্থ শিখারও কিতাব ৷ তাইসীরুল মুবতাদী পড়ার পর একই বছরের অবশিষ্ট সময়ে ফার্সি কি পহলী পড়ানো হয় ৷ এরপর মীযানের বছর ফার্সির জন্য থাকে একটি মাত্র সবক ৷ যাতে কারীমা,পান্দেনামা ইত্যদি কিতাব থাকে ৷ আর নাহবেমীর ও হেদায়াতুন্নাহুর বছর আংশিক সবকেই গুলিস্তাঁ-বোস্তাঁ পড়ানো হয় ৷ এছাড়াও মীযানুস সরফ, নাহবেমীর ও মালাবুদ্দা মিনহুতে সরফ,নাহু ও ফিকহের মাসায়েল চর্চার মধ্য দিয়ে ফার্সিভাষারও কিছুটা চর্চা হয়ে যায় ৷ এভাবে তিন চার বছরের অল্প অল্প আংশিক ক্লাসে একটু একটু ফার্সি পড়েই শিক্ষার্থীরা ফার্সি সাহিত্যের উচ্চাঙ্গের কিতাব গুলিস্তাঁ,বোস্তাঁ বুঝার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে ৷ তবে বর্তমানে ফার্সিভাষা শিখার বা তার সাথে ন্যুনতম সম্পর্ক থাকার ব্যপারেও নেতিবাচক প্রচারণায় অবস্থার অবনতি ঘটছে ৷
ইংলিশ:
অধিকাংশ মাদরাসাতেই বর্তমানে ইংলিশের সামান্য শিক্ষার ব্যবস্থা আছে ৷ বেফাকুল মাদারিস পঞ্চম শ্রেণীতে ফার্সি অথবা ইংলিশের দুটি অপসন রেখেছে ৷ এরপর বেফাকের আর কোনো পরীক্ষাতে ইংলিশের বালাই নেই ৷ পূর্ণাঙ্গ কোর্সের মাদরাসাগুলোতে তো ইংলিশের সাথে ন্যুনতম সম্পর্ক তৈরি করে দেয়ার চেষ্টা হয় ৷ কিন্তু সর্টকোর্সের মাদরাসাগুলোর অবস্থা আরো খারাপ ৷
এই হলো কওমী মাদরাসাশিক্ষা ব্যবস্থায় ভাষাশিক্ষার বর্তমান চিত্র ৷
……………………… চলবে ইনশাআল্লাহ ৷